যান্ত্রিক
শিহানুল_ইসলাম
__বড় রাস্তা ঘেষে এই চায়ের
দোকানটিতে সকালের দিকে তেমন ভীড়
থাকে না ৷ সদ্য জ্বালানো উনুনের
ধোয়া তে চারপাশটা কেমন যেন
ঢেকে আসে একেবারে ৷
সামনে আড়াআড়িভাবে পাতানো বাঁশের
বেঞ্চিতে সাত আট জনের বেশি ধরে না ৷
তবে আশপাশটা বেশ ছিমছাম ৷ বেঞ্চির
একধারে বসে তরুণ এসব
খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল ৷ যদিও এখানে ও আজ
প্রথম নয় ৷ রোজ সকালের
দিকে এখানে এসে আয়েস করে দু'কাপ
চা খেয়ে যায় তরুণ ৷ মন্দ লাগে না!
__রূপা চলে যাওয়ার পর থেকে বাসায়
সকালের চায়ের পাটটা চুকে গেছে ৷ সকাল
৮টার মধ্যে কাজের বুয়া এসে অফিসের ভাত
রেঁধে দিয়ে যায় ৷ সাড়ে ৮টায় বাসায়
ফেরে তরুণ ৷ সোজা বাথরুম ৷ অলস
হস্তে গালে রেজার টেনে সাওয়ার
খুলে নিচে বসে থাকে কিছুক্ষণ ৷
ধুয়ে ফেলে সব ৷ নিজেকে ৷ তরুণের সমস্ত
সম্ভাব্য গ্লানি কে ৷
__ঠিক ৯টা বেজে ৩০ মিনিটে রোজ তরুণ
কে বড় রাস্তার
মোড়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ৷ বাস
আসে ৯টা ৩৫ কি ৩৭ মিনিটের মাথায় ৷
এখানে ঠিক ১ মিনিট দাড়ায় ৷ যদিও
এখানে তরুণ ছাড়া সাধারণত অন্য কোন
যাত্রী দাড়িয়ে থাকে না ৷ তবু দাড়ায়
বাসটা ৷ নিয়ম হয়ে গেছে একটা ৷
__৯টা ৫৫ মিনিটে অফিসের শিড়ির প্রথম
ধাপে পা রাখে তরুণ ৷ দ্বিতীয়
ধাপে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে একটা চাপা স্বস্থির
নিঃশ্বাস ফেলে সে ৷ তারপর
আস্তে আস্তে একটার পর
একটা শিড়ি ভাঙ্গতে থাকে তরুণ ৷ আজকাল
এই শিড়ি ভাঙ্গাটা বেশ কষ্টকর
হয়ে গেছে তার কাছে ৷ ৩৭ বছরের
পেটানো শরীরেও হাফ ধরে যায় ৷ মাত্র
তো চারটে তলা ৷ উহ! মনে হয়
শিড়ি ভাঙ্গছি না তো, যেন যমের
বাড়ি যাচ্ছি ৷
__কাটায় কাটায় ঠিক ১০টায় তরুণ তার
টেবিল-চেয়ারটাতে
নিজেকে সপে দিতে পারে ৷ তারপর
সামনের ফাইলটা খুলে কলম দিয়ে কিছু
একটা ঠুকে আবার বন্ধ করে রাখে ৷ সেই সময়
বেয়াড়া এসে টেবিলে এক গ্লাস
পানি রেখে যায় ৷
__তরুণ অনেকদিন এসব কাজ
মিলিয়ে দেখেছে ৷ অজান্তেই যেন সব কিছু
ঠিকঠাকমতো চলতে থাকে ৷ এতটুকুও টাইমের
হেরফের হয় না ৷ তাহলে কি তরুণ সত্যিই
যান্ত্রিক? তরুণ, রূপা কি তাহলে ঠিকই...৷
__বলার মতো তেমন কোন বাজে অভ্যাস নেই
তরুণের ৷ ঠিক ৫টায় সে অফিস
থেকে বাড়িতে ফেরে ৷ আজও ফিরলো ৷
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সামনের
দিকে তাকিয়ে থাকে কিছক্ষণ ৷ কোণার
দিকে আড়াআড়ি ভাবে পাতা ডাবল
সোফাসেট ৷ সামনে কাচের সেন্টার টেবিল
৷ উল্টোদিকে ক্যাবিনেটে টিভি সেট ৷
পাশে রিমোট কন্ট্রোলার টা নিথর
হয়ে পড়ে আছে ৷ প্রতিদিনের অতি পরিচিত
চিত্র ৷ সবকিছু ছিমছাম ৷ সব যান্ত্রিক ৷
__হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই রূপার
কথা মনে হলো তরুণের ৷ আচ্ছা,
রাপা থাকলে কি সবকিছু এরকম নিস্তব্ধ
ভাবে গোছানো থাকতো? সামনের সকল
বস্তুই কি জীবন্ত হয়ে যেত না? কে জানে,
কি! তরুণ আর ভাবতে পারলো না ৷
__সমস্যাটা শুরু হয়েছিল বিয়ের ছ'মাসের
মাথায় ৷ হঠাৎ একদিন খুব সকালে ডাঙ্গায়
তোলা মাছের মতো ছটফট করতে করতে ঘুম
থেকে উঠলো রূপা ৷ পাশে তখনো তরুণ মরার
মতো পরে আছে ৷ তার ঘুমন্ত দেহটির
দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল
রূপা ৷ এক মুহুর্ত, তারপর নাক-মুখ
কুচকে স্বশব্দে একদলা থুতু
ছুড়ে দিলো তরুণকে লক্ষ করে ৷ যেন তরুণ মানুষ
নয়, তার স্বামী নয় ৷ তার অজাত শত্রু ৷
__শীতের সকাল ৷ ঠান্ডা হিম একদলা থুতুর
স্পর্শে বিছানা থেকে এক প্রকার লাফিয়েই
উঠেছিল তরুণ ৷
"একি! এরকম থুতু ছুড়ে মারলে কেন? পাগল
হয়ে গেলে"....
__সামনের দিকে তাকিয়ে কথা থেমে গেল
তরুণের ৷ রূপার এরকম রুদ্রমূর্তি আর
কখনো দেখেনি তরুণ ৷ মাথার চুল
এলোমেলো ভাবে উস্কখুস্কো হয়ে আছে ৷
চোখ দু'টো যেন শিকারীর চোখের মতন
ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে ৷
সারা শরীর রাগে অভিমানে থরথর
করে কাপছে শুধু ৷ তরুণ কিছুক্ষণ রূপার
দিকে তাকিয়ে খুব মনযোগ সহকারে কি যেন
ভাবলো ৷ তারপর...
"কি ব্যাপার! চুলে শ্যাম্পু করো না কেন?
দেখো তো, কি অবস্থা হয়েছে চুলের! আজই
শ্যাম্পু করে নেবে ৷ আচ্ছা, শ্যাম্পু আছো তো!
নাকি ফুরিয়ে গেছে?"
__কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল তরুণ ৷
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রূপা ৷
কিছুক্ষণ আগের সেই ভয়ংকর অশীরীর রূপ আর
নেই তার মধ্যে ৷ জোকের মুখে এক চিলতে লবন
ছড়িয়ে দিলে যেমন হয় ৷ কেমন যেন
মিইয়ে গেছে একেবারে ৷ আর সেই উদ্ভ্রান্ত
অপলক দৃষ্টির
মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হতাশা,
ধিক্কার, অবিশ্বাস ও এক আশাতীত সম্ভাবনার
মৃত্যু ৷
__সেদিনই কথা বন্ধ হয়েছিল রূপার ৷ আর
কোনদিন তার মুখ দিয়ে কেউ একটা কথাও
বলতে শোনেনি ৷ কেমন যান্ত্রিক
হয়ে গিয়েছিল ৷ যে যা বলতো, ঘাড়
গুজে শুনে যেত ৷ যার যা প্রয়োজন, বলার
আগেই হাজির হয়ে যায় ৷ যেন গোটা সংসার
টা পরম নিশ্চিন্তে রূপার ঘাড়ের উপর
ঘুমিয়ে পড়েছিল ৷ স্বস্থির নিশ্বাস
ফেলেছিল তরুণ ৷ যাক, শেষ পর্যন্ত
সংসারে মনযোগ দিতে পেরেছে অন্তত ৷
__রূপা থাকতে একটা জিনিস খুব
ভালো করে লক্ষ করে দেখেছে তরুণ,
যে মেয়েটা এক জায়গায় ১০ মিনিট
নিজেকে স্বস্থির রাখতো না, সেই
মেয়েটা হঠাৎই কেমন
সংসারী হয়ে উঠেছে ৷ সময় মানুষ কে কত
বদলে দেয় ৷ ঠিক যেমনটি রূপা ৷ রূপার সংসার ৷
বাড়ির প্রত্যেকটা জিনিস যেন
রূপা বলতে পাগল ৷ রূপার হাতের ছোঁয়ায়
বাড়ি যেন একদম জীবন্ত লাগে ৷ সবকিছুর
দিকে কেমন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে শুধু
৷ কিন্তুু তরুণের সে সময় কই? ঐ
তাকিয়ে থাকা পর্যন্তই ৷
ওগুলো নিয়ে আলাদা করে ভাববার সময়
তরুণের ছিল না ৷ তরুণ যে বড্ড যান্ত্রিক! তরুণ
একঘেয়ে...৷
__সেদিন সকালে কার যেন হাতের ধাক্কায়
একদম ধড়ফর করে ঘুম থেকে উঠেছিল তরুণ ৷
নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক মূহুর্ত সময়
নিয়েছিল সে ৷ তারপর
সামনে তাকিয়ে দেখে সুরুজ
দাড়িয়ে আছে ৷ বাসার ১২বছর বয়সী কাজের
ছেলেটা...
"কিরে, সুরুজ! দিলি তো সকাল সকাল
ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে ৷ ৯টায় অফিস, তার
আগে দু'টো ঘন্টা ভালো করে ঘুমোতেও
দিবি না ৷ ভাল্লাগে না আর___রূপা! রূপা!
তুমি থাকতে এ".....
"ইয়ে, স্যার! হয়েছে কি"...
"কি, কি হয়েছে এই সাত সকালে যে,
আমাকে ডাকতে হয় ৷ তুই জানিস আমি ঠিক
৮টা পর্যন্ত ঘুমাই ৷"
"আসলে, আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি, ম্যাডাম
পড়ে আছে কিচেনের মেঝেয় ৷ হুস নেই,
অজ্ঞান ৷ আমি চোখ মুখে পানি দিলাম, তবু
জাগছে না ৷ আমার ভয় করছে স্যার!"
"কি বলছিস তুই! চল দেখি কোথায়"...
__সাথে সাথে তরুণ আর সুরুজ
দৌড়ে গিয়েছিল কিচেনে ৷ দরজার সামনেই
রূপার নিথর দেহটি পড়েছিল ৷ তরুণ
গিয়ে একেবারে সাপটে ধরেছিল রূপা কে ৷
ঠান্ডা, একদম হিম হয়ে গেছে রূপা ৷ রূপা একদম
নিশ্চল ৷
__পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট বলেছিলো,
রূপা অনেকগুলি স্লিপিং পিল
একসাথে খেয়ে ফেলে ৷ তবে তরুণকে উদ্দেশ্য
করে রূপার লেখা শেষ চিঠিটা কিন্তু
সে কথা বলে না ৷
বরং রূপা মরেছিলো অনেক আগেই ৷
তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল ৷ তরুণ নিজেই
রূপা কে মেরেছে ৷ অন্তত আজ এই রূপার
না থাকাটা করুণ কে তাই মনে করিয়ে দেয় ৷
সে বাঁচাতে পারতো রূপা কে ৷ একমাত্র সেই
পারতো...৷
"তরুণ"
তুমি স্বামী হিসেবে মোটেও খারাপ না ৷
যথেষ্ট সুন্দর, দ্বায়িত্ববান ৷ একজন মেয়ে ঠিক
তোমার মতো বরই স্বপ্নে দেখে ৷ তবু বলবো,
তুমি অসম্পূর্ণ ছিলে ৷ তোমার মধ্যে নতুনত্ত্বের
বড্ড অভাব ছিল ৷
তুমি পুরনো একটা জং ধরা স্বপ্ন
নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইতে ৷ অথচ প্রতিদিন
ছোট ছোট নতুন স্বপ্ন দেখাতে যে কত আনন্দ,
তা তুমি ঘূর্ণাক্ষরেও বোঝনি ৷ স্বপ্নগুলো পূরণ
হোক বা না হোক, তবু যেন দেখাতেই সব আনন্দ
লুকিয়ে থাকে ৷
তোমাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছিল,
তুমি আমায় বুঝলে না ৷ আমার সেই চরম
দুরন্তপনাকেও তোমার যান্ত্রিক জীবন একদম
নিথর করে দিলো ৷
শেষে, নিজেকে বাধ্য হয়ে তোমার মাঝেই
প্রথিত করতে চাইলাম ৷ তোমার সংসারের
মাঝে ৷ হলো না, শেষ পর্যন্ত পারলাম না ৷
নিজের সাথে আর কতক্ষন অভিনয় করা যায়,
তরুণ!
"রূপা"
__সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে সোফায়
নিজেকে এলিয়ে দিলো তরুণ ৷
আপনাআপনি বুজে এলো চোখ দু'টো ৷
সামনে আবছা অন্ধকার ৷ সেই
আবছা অন্ধকারে ভেসে উঠলো, চিঠি, সেই
শেষ চিঠিটা...৷
"স্যার! রাতে কি খাবেন? রুটি, না ভাত"...
__চোখ মেললো তরুণ ৷ সামনে কাচুমাচু
হয়ে বুয়া দাড়িয়ে আছে ৷ নতুন কাজের বুয়া ৷
রুপা চলে যাওয়ার পর সুরুজ নিজে থেকেই
চলে গেছে ৷ হয়তো অন্য কোন রূপার
কাছে আবার কাজ নিয়েছে ৷
বাংলাদশে রূপাদের খুব একটা বোধহয় অভাব
নেই ৷ অভাব শুধু তরুণদের ৷
__হাতের ইশারায় কি যেন বলতে চাইলো তরুণ,
বলতে পারলো না ৷ কি বুঝে বুয়া কিচেনের
দিকে হাটতে লাগলো ৷ তরুণ ডাকলো...
"বুয়া, শোনো! ক'দিন ধরে দেখছি, ওজন বড্ড
বেড়েছে আমার ৷ ভাত দরকার নেই,
তুমি বরং রুটিই করো ৷"
__বুয়া চলে গেল ৷ তরুণ আবার সোফায় পিঠ
ঠেকিয়ে সামনের অসীম শুন্যতায়
তাকিয়ে রইলো ৷ হঠাৎ সমস্ত ঘর
অন্ধকারে ঢেকে গেল একেবারে ৷ কোথাও
এতটুকু আলোর রেখা নেই ৷ আর ঠিক
তখনি কে যেন শব্দ করে হেসে উঠে অশীরীর
গলায় বলতে লাগলো...
"ছিঃ! তরুণ, তুমি বড্ড যান্ত্রিক ৷
তুমি বরং বলতে পারতে, বুয়া! আজ
রাতে জমিয়ে খিচুড়ি করো তো একটু ৷ কতদিন
খিচুড়ি খাইনি...৷
__তরুণ নির্বাক ৷ তরুণ নিস্পন্দ ৷ এতটুকু নড়াচড়ার
শক্তিও যেন তার রইলো না আর ৷ অস্ফুটে শুধু
একবার বলতে পারলো সে......রূপা!
শিহানুল ইসলাম
২০ ডিসেম্বর, ২০১৪
বগুড়া ৷
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন