অপেক্ষা
এম এ ওহাব মন্ডল
""""""""""""""""""'"
সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লেকের
পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের
নিচে একা একা বসে আছি।
মনটা ভালো নেই। অন্যরকম এক
অস্থিরতা প্রাণের ভেতর বিরাজ
করছে। বারবার শুধু লিজার অনিন্দ্য
মুখাবয়বের কথা আমার দৃষ্টির
ক্যানভাসে সহসা ভেসে আসছে।
লিজাকে আমি ভালোবাসি।
লিজা আমার সত্তার শিহরণ।
লিজার উপেক্ষিত দৃষ্টির
কারণে আমি অনেকবার
ওকে ভোলার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু আমি যতবার আমার
‘সোনা পাখি’
লিজাকে ভুলতে আত্মমগ্ন
হয়েছি ঠিক ততবারই আমি ব্যর্থ
হয়েছি। আমার সংবেদনশীল প্রেম
আরো প্রগাঢ় হয়েছে। কাউকে হৃদয়
সিংহাসনে ঠাঁই
দেয়া অনেকটা সহজ হলেও
কাউকে ভুলে যাওয়া অনেক কঠিন।
আর সত্যিকারের ভালোবাসার
মানুষকে তো কোনোভাবেই
ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমার প্রতি লিজার অসামান্য
অবহেলার পরও প্রতিনিয়ত,
প্রতিটি মুহ
‚র্তে ওকে নিয়ে আমি আমার
এলোমেলো স্বপ্নের রাজ্য
সাজাই। ভাবনার
আর্টি পেপারে ভালোবাসার
রঙতুলি দিয়ে অঙ্কন করি ওর
টোলপড়া হাসির অনিন্দ্য
প্রতিচ্ছবি।
আজ দিয়ে প্রায় ১৭ দিন
হলো লিজার সামনে যাই না।
কিন্তু প্রতিদিন অন্তত একবার
হলেও আড়াল থেকে আমার
‘সোনা পাখি’কে দেখে নিই। ওর
মায়াবী আনলখানি এক পলক
না দেখলে আমার যাতনার
সমীকরণ ক্রমশ দীর্ঘায়িত হয়।
প্রাণের অদৃশ্য শহর কষ্টের নীল
রঙে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে মনের
মধ্যে ভাবনা আসে।
ভালোবাসা কেন এমন হয়- যখন
ছেলে মেয়েকে চায়, তখন
মেয়ে ছেলেকে চায় না, যখন
মেয়ে ছেলেকে চায়; তখন
ছেলে মেয়েকে চায় না।
যা হোক, আজ লিজার সামনা-
সামনি গিয়ে দাঁড়াবো।
অনেকদিন হলো আমার
‘সোনা পাখির’
সামনে বা কাছাকাছি যাওয়া হয়
না। ওকে কিছু বলা হয় না। যদিও
আমার প্রতি লিজার অসামান্য
অবহেলা; সীমাহীন ঘৃণা- তবুও ওর
কাছে আমার যেতে হবে।
কেননা লিজাই আমার কাক্সিক্ষত
স্বপ্ন পূরণের একমাত্র সোপান।
আমি সব সময় প্রত্যাশায়
থাকি যদি কখনো লিজার
ঘৃণাভরা চোখে আমার জন্য
একমুঠো ভালোবাসার জল ঝরে।
কেননা হাসির
বিপরীতে কান্না; দুঃখের
পাশেই সুখের বসবাস।
আর তাই তো বারবার লিজার
কাছে ছুটে ছুটে আসি ভালোবাসা পাওয়ার
প্রত্যাশায়। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।
আমি মসজিদ মার্কেটের
জিরো পয়েন্টে লিজার জন্য
অপেক্ষা করছি।
বৃষ্টি ছেড়ে যাওয়ার পর
লিজা কোচিং থেকে রিকশায়
করে এল। আমিও
একটা রিকশা নিয়ে লিজার সঙ্গ
নিই।
লিজা রিকশা থেকে নামলে আমি বলি ‘লিজা’।
পিছু
ফিরে লিজা আমাকে দেখে মুখ
ফিরিয়ে নেয়। আমি বললাম,
‘প্লিজ লিজা, আমি কি বলতে চাই
তা শোনো।’
লিজা কোনো কথা না বলে হাঁটতে শুরু
করে। পুনরায় আমি বলি- ‘লিজা,
প্লিজ ডোন্ট মুভ। তুমি আর কত কষ্ট
দেবে আমাকে?
তোমাকে ছাড়া আমার দিন-রাত
কাটতে চায় না।
প্রতিটি মুহ‚র্তে তুমি আমার
ভাবনাকাশে সাদা মেঘের
মতো ভেসে বেড়াও। বিশ্বাস
করো লিজা, আমার জীবনে তুমিই
একমাত্র মেয়ে- যার জন্য আমার
সত্তার ভেতর ক্ষণে ক্ষণে স্বপ্ন
সাজাই। প্লিজ লিজা, আমার
রিক্তহস্ত ভালোবাসার
অনুদানে ভরে দাও।
আমি কথা দিচ্ছি আমার সাধ্যের
অর্জনের সবটুকু সুখ তোমার
চরণে ঢেলে দেব।
আমাকে ছেড়ে আর
দূরে দূরে থেকো না।’
এবারো লিজা কোনো কথা না বলে হাঁটতে শুরু
করে। আমার হৃদস্পন্দন বাড়তে শুরু
করে।
আমি লিজার
সামনে দাঁড়িয়ে বলি-
‘লিজা তুমি আমাকে নিয়ে কি ভাবো জানি না।
দীর্ঘ ১ বছর ৯ মাস ধরে তোমার জন্য
আমার প্রাণের ভেতর
ভালোবাসা লালন করছি।
এতদিনে তুমি কি একটা মুহ‚র্তের
জন্যও আমার কথা ফিল করোনি?
আমি তোমাকে সত্যিই অনেক
ভালোবাসি লিজা। দীর্ঘ
এতটা সময় ধরে আমি তোমার
কাছে যতবার ভালোবাসার
কথা বলেছি তুমি বরাবরই নীরব
দেবীর মতো তা শুধু শ্রবণ করেছ।
কখনো একটি কথার প্রত্যুত্তর
করোনি। ‘নীরবতা সম্মতির লক্ষণ’
কথাটার ওপর ভিত্তি করেই
কি ধরে নিব আমার
ব্যাপারে তোমার ‘সায়’ আছে (?)’
কথাগুলো শেষ না হতেই
দেখি লিজার
বাবা রাস্তা দিয়ে আসছে।
লিজা ওর বাবাকে দেখতে পায়
না। আর
কোনো কথা না বলে আমি লিজাকে বিদায়
জানিয়ে চলে আসি।
কেটে যায় কিছু দিন। আমার
ভেতরের অন্তর্দহন যেন ক্রমাগত
বাড়তে থাকে। আমার
ব্যাপারে লিজার পক্ষ
থেকে কোনো প্রকার
সাড়া আসে না।
জানতে পারি লিজা আজ
দুপুরে ওর দাদি বাড়িতে যাবে।
আমি যথাসময়ে খঞ্জনপুর চক্ষু
হাসপাতালের
সামনে গিয়ে অপেক্ষা করি।
লিজা এই পথ দিয়েই ওর দাদির
বাড়িতে যাবে। একটু পর লিজা ওর
ছোট
ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে।
অতিরিক্ত যানজটের
কারণে আমি লিজার
সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ
পাইনি। লিজা চলে যায়। শুধু হাত
ইশারা করে বিদায় জানাই।
লিজার
চোখে অনেকটা অস্বস্তির জলছাপ
দেখতে পাই। আমার বুকের ভেতর
অদৃশ্য এক নির্মম কষ্টের পাহাড়
আচমকা ভেঙে পড়ে।
দুদিন পর লিজা বাড়িতে ফিরে।
লিজার কোচিংয়ে কাল
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
লিজা অনুষ্ঠানে একটা গান
গাইবে। অনুষ্ঠান শুরুর
প্রস্তুতি চলছে। আজ
লিজা শাড়ি পরেছে।
শাড়ি পরে লিজাকে অসম্ভব সুন্দর
দেখাচ্ছে।
শাড়িতে যে লিজাকে এমন
বর্ণনাতীত সুন্দর দেখায় জানতাম
না। শ্যাম্পু করা খোলা চুল, শুভ্র
শাড়ির কুঁচি, আর গোলাপি অধরের
টোলপড়া হাসির উৎসব
আমাকে দৈব্য বেসামাল
করে তোলে।
লিজা অনুষ্ঠানে আরেফিন রুমির
‘বাতাসে কান পেতে থাকি এই
বুঝি ডাকছ তুমি…।’ গানটি গায়।
লিজার গানের কণ্ঠও কল্পনাতীত
সুন্দর। রীতিমতো মুগ্ধকর।
কেটে যায় অনেকগুলো দিন। এর
মধ্যে ছোট ছোট অনেক ঘটনার
সৃষ্টি হয়। একদিন লিজার
সহপাঠী রোহিতের সঙ্গে দেখা।
রোহিত আমাকে দেখে কেমন
আছি- জানতে চায়।
আমি রোহিতকে বলি-
: লিজা, কিছু বলেছে? রোহিত
বলে
: না ভাইয়া। তবে লিজা প্রায় সময়
আপনার প্রসঙ্গ তোলে।
আসলে ওকে বোঝা কঠিন।
কখনো কখনো ও আপনার নামই
শুনতে পারে না। আবার
মাঝে মাঝে ও নিজের
থেকে আপনার কথা বলে। কিছুদিন
আগে লিজা আমাকে আপনার
কথা জিজ্ঞেস করেছিল।
বলেছিল- কি রে রোহিত তোর
‘অংকন’ ভাইয়াকে দেখা যায়
যে কোথায় থাকে? আমি বলেছি-
অংকন ভাইয়ার খবর তুই
ভালো জানিস।
আমি উৎকণ্ঠার স্বরে বললাম-
‘সত্যি তাই?’ এরপর রোহিত
চলে যায়। রোহিতের
কথা শুনে প্রাণের ভেতর এক
পশলা শীতল বৃষ্টি নামে।
আমি নিউমার্কেট থেকে বের
হতেই দেখি লিজা ওর মা আর ও এক
আন্টি একটা দোকানে কাপড়
কিনছে।
লিজাকে দেখে আমি থমকে যাই।
কিছুক্ষণ পর
লিজা আমাকে দেখতে পায়।
ওরা প্রায় এক ঘণ্টার
মতো মার্কেটে থাকে। আমিও দূর
থেকে ওদের দেখি। লিজা একটু
পরপর আমার দিকে তাকায়।
লিজা ওরা মার্কেট থেকে বের
হলে আমিও বাড়িতে চলে আসি।
আমি লিজাকে অনেকবার আমার
ভালোবাসার কথা বুঝিয়েছি। তবু
সে কখনো আমার প্রস্তাবে একমত
হয়নি। জোছনা রাত। আমার ঘরের
জানালা খোলা। আমি খাটের
ওপর শুয়ে আছি। আমার
পিসিতে পুরনো দিনের গান
বাজছে। জোছনার
আলো জানালা ভেদ করে আমার
চোখে-মুখে নৃত্য করছে। বালিশের
পাশে থাকা আমার
সেলফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল।
হাতে নিয়ে অপরিচিত নম্বর
দেখে সম্মানসূচক সালাম
জানিয়ে বলি-
: হ্যালো কে বলছেন? ওপাশ
থেকে এক ভদ্র মহিলার কণ্ঠ
ভেসে এল।
: আপনি কে?
আমি কথা না বাড়িয়ে এক
বাক্যে বলি-
: আমি অংকন। এবার ভদ্র
মহিলা বললেন-
: আমি লিজার মা। এ
কথা শুনে তো আমি থমকে যাই।
আমার হৃদস্পন্দন
বিদ্যুৎগতিতে ওঠানামা করতে আরম্ভ
করে। এবার একটু নীরব থাকার পর
কোনো প্রকার
ভনিতা না করে বললাম-
: আন্টি আপনি কেমন আছেন?
: জি ভালো। অংকন, আমি বিশেষ
কিছু কথা বলতে তোমাকে ফোন
দিয়েছি।
: জি আন্টি বলুন।
: অংকন, আমি তোমার
সম্পর্কে সবকিছু জেনেই
তোমাকে ফোন দিয়েছে। সবকিছু
বোঝার মতো তোমার যথেষ্ট বয়স
হয়েছে। তুমি অবশ্যই জানবে প্রেম-
ভালোবাসা কখনো একতরফা হয়
না। তুমি আমার
মেয়েকে ভালোবাসো। কিন্তু
সে তোমাকে ভালোবাসে না।
আর এসব কখনো জোর করে আদায়
করা যায় না। প্রেম-
ভালোবাসা হচ্ছে সম্পূর্ণ
হৃদয়কেন্দ্রিক ব্যাপার।
আত্মার সম্মতিই প্রেম। যেহেতু
লিজা বর্তমানে তোমাকে চাইছে না সেহেতু
লিজাকে পথেঘাটে কিছু
বলো না।
যদি সে তোমাকে কখনো ভালোবাসে তাহলে সে অবশ্যই
তোমার কাছে যাবে।
আর
লিজা যদি তোমাকে পেতে চায়
তাহলে আমাদের কোনো প্রকার
আপত্তি থাকবে না।
আর এ যুগের
ছেলেমেয়ে তো মনের
বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না। আর
বিশেষ কিছু বলতে চাই না।
আমি মনে করি আমি যা বলেছি তার
সবটায় তুমি বুঝেছ।
: আপনাকে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে ছোট
করব না। সত্যি আপনি জগতের একজন
শ্রেষ্ঠ মা। আপনার
কথা শুনে আমার অনেক
ভালো লাগল। আমার জন্য
দোয়া রাখবেন। ভালো থাকবেন
সব সময়।
এ কথা বলে ফোন কেটে দিই।
তারপর লিজার মার
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাত
প্রায় শেষ হয়ে যায়।
কেটে যায় অনেকগুলো দিন।
লিজার সামনে আর যাওয়া হয় না।
ভীষণ এক চাপা কষ্ট বুকের ভেতর
নিয়ে ফেরারি প্রেমিকের
মতো অতিবাহিত হয় আমার
প্রত্যেকটা মুহ‚র্ত।
লিজা রাস্তা দিয়ে চলাচল
করে আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি।
আজ অনেক দিন পর খু-উ-ব
ইচ্ছে হলো লিজাকে একটা চিরকুট
লিখব। চিরকুট লিখে পাঠিয়ে দিই
লিজার কাছে।
চিরকুটে লেখা আছে-
সোনা পাখি,
তোমার জন্য অনেক শুভেচ্ছা ও শুভ
কামনা। হয়তো অনেক ভালো আছ
তুমি। কিন্তু আমি একদম
ভালো নেই। তোমার প্রতীক্ষায়
আমার প্রত্যেকটা মুহ‚র্ত কাটে।
সে দিনের পর
থেকে মানে আন্টি ফোন দেয়ার
পর থেকে তোমার
সামনে যাওয়া হয় না।
তাই বলে ভেবো না-
আমি তোমার চোখের আড়াল
হয়েছি মানে তোমাকে ভুলে গেছি।
আমি তোমার চারপাশেই
আছি ছায়ার মতো। তোমার
ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ
চেয়ে আছি। জানি না, আমার
অপেক্ষার প্রহরগুলো কবে শেষ
হবে। ভালো থেকো।
ইতি-
তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায়
‘অংকন’।
লিজার ফিরে আসার প্রত্যাশায়
সব সময় হৃদয়ের অভ্যন্তরে লিজার
জন্য মুঠো মুঠো ভালোবাসা চাষ
করি।
# গুলশান মোড়,জয়পুরহাট-৫৯০০
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন